Home সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছোট গল্প জন্মদিন | মৌমিতা সাহা

জন্মদিন | মৌমিতা সাহা

0

বাড়ী বাড়ী কাজ করে সংসার চালায় রিতা। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবনের চাওয়া পাওয়া গুলো।

রোজকার মতো আজও ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো রিতার। স্নান করে, কাপড় বদলে ছুটলো রান্নাঘরে। সাতটার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ করে ছেলেটাকে স্কুলের জন্য তৈরী করতে হবে। ওর ছেলের বয়স সাত, নাম মিকু। রিতার একটাই বাসনা, ছেলেটা শিক্ষিত হোক। অশিক্ষার জ্বালা রিতা হাড়ে হাড়ে টের পায়। বাবা যদি মায়ের কথা শুনে ওকে পড়াশোনা শেখাতো তাহলে আজ মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচতে পারত।

মিকুকে  শিবানী বৌদির কাছে পৌঁছে দিল। নিজের ছেলে আর মিকুকে একসাথে নিয়ে স্কুলে নিয়ে যায় বৌদি। রিতা না ফেরা অবধি নিজের কাছেই রাখে।

নিজের টিফিন গুছিয়ে নিয়ে বাকি খাবারটা আলমারিতে রেখে দিল। তাকিয়ে দেখলো স্বামীর রাতের নেশার ঘুম তখনও ভাঙেনি। শিবানী বৌদির সাথে দুটো কথা বলতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো আজ। অর্ধেক রাস্তা পৌঁছেছে এমন সময় ফোন বাজল।

‘দিদি এই তো প্রায় পৌঁছে গেছি।’

ফোনটা রাখলো রিতা। এই হচ্ছে মুশকিল নতুন কাজের বাড়ির বৌদিকে নিয়ে। পাঁচ মিনিট দেরী হলেই আয়া সেন্টারে ফোন করবে।

দরজায় বেল বাজাতেই দোতলা থেকে ব্যাগে করে চাবি নেমে এলো। ঘরে ঢুকে কাপড় পাল্টে পরিষ্কার কাপড় পড়তে হলো। এটা ওদের নিয়ম। তারপর বুড়ির কপালে হাত রেখে বললো,

‘ঠাকুমা তো ভালোই আছে। শুধু শুধু সেন্টারে ফোন করতে গেলে কেন বৌদি।’

রিতার গা জ্বালা করছিলো। সেন্টারে কাজের বাড়ি থেকে ফোন আসাটা দিদিরা পছন্দ করেনা। বার বার বলা আছে কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ যে ন না আসে কাজের বাড়ি থেকে।

এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে নেমে পরলো। বুড়িকে বাথরুম করিয়ে, মাথা ধুইয়ে, গা স্পঞ্জ করিয়ে, একটা থালায় গলা ভাত, ডাল আর আলুসেদ্ধ খাইয়ে দিলো। তারপর আগের রাতের প্রস্রাবে ভেজানো চাদর আর গায়ের কাপড় কেচে ছাদে মেলে এলো। এরপর বুড়ির চুল আঁচড়ে একটা আয়না মেলে ধরলো সামনে। বুড়ির প্যারালাইসিস হয়েছে ঠিকই কিন্তু নিজেকে পরিপাটি দেখতে খুব ভালোবাসে। তাই আয়নায় নিজেকে দেখে ফোকলা দাঁতে হাসি দেয়। তখন রিতা খুব মজা লাগে। বুড়ির গাল টিপে মস্করা করে।

এরপর একটু জিরোয়। আজকাল বড্ড হাঁপিয়ে যাচ্ছে।কে জানে কি ব্যারাম হয়েছে! ডাক্তার দেখিয়েছিল। কি সব পরীক্ষা করতে বলেছে। খরচ শুনে পালিয়ে এসেছিলো রিতা। ওসব বড়লোকেদের রোগ। তার মত কাজের লোকেদের এসব রোগের চিকিৎসা করা বিলাসিতার সমান।

টিফিন বাক্স খুলে রুটি আর ঢেঁড়সের তরকারি মুখে তুলতে গিয়ে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পরে চোখে জল চলে এলো। আসলে আজকের দিনটা মাকে খুব মনে পরে।

‘রিতা আজ তোমার টিফিনটা রেখে দাও।’

চমকে ওঠে রিতা।

‘কেন বৌদি, আমি তো সব কাজ সেরে খেতে বসেছি।’

‘জানি। আজ তোমার জন্য মাছ আর মুরগির মাংস রান্না করেছি।’

থালাখানা এগিয়ে দিলো মহিলা।

রিতার বিস্ময় কাটেনা।

‘সেন্টারে ফোন করেছিলাম যখন, ওরা বললো আজ তোমার জন্মদিন। আজ চাইলে, তুমি কাজে নাও আসতে পারো। কিন্তু তুমি তোমার কর্তব্য করতে আজও উপস্থিত হয়েছো। তাই এটুকু করা যে আমারও কর্তব্য। শুভ জন্মদিন রিতা। ভাল থেকো।’

মহিলা হাতের বাটি থেকে এক চামচ পায়েস খাইয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলো রিতাকে।

রিতা ওর বৌদির পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। মা ছোটবেলায় এমন ভাবেই পায়েস খাইয়ে দিত জন্মদিনের দিন। ছলছল চোখ দেখলো বুড়ি ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। রিতা খাবার ছেড়ে উঠে জড়িয়ে ধরল বুড়িকে।

‘ঠাকুমা আজ তোমাকে জাপটে ধরবো, ছাড়বোই না। তোমার জন্য মাকে আবার ফিরে পেলাম।’

বুড়ি তখনও ফোকলা দাঁতে হেসে চলেছে।

 

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version