পঞ্চানন কর্মকারের স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনে ভরে উঠল খেলাত ভবন

বাংলা ভাষা ও মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে এক দীপ্তিমান অধ্যায় রচনা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার, যাঁকে যথার্থই বলা হয় বাংলা লিপির জনক। সম্প্রতি কলকাতার খেলাত ভবনে আয়োজিত ‘হরফ’ শীর্ষক এক ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীতে তাঁর সংরক্ষিত নিদর্শনসমূহ প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আনা হয়েছিল। ১৫ই এপ্রিল সমাপ্ত হওয়া এই প্রদর্শনী ছিল এক সপ্তাহব্যাপী এক নিঃশব্দ অথচ হৃদয়গ্রাহী শ্রদ্ধার্ঘ্য, যেখানে বাংলা মুদ্রণশিল্পের সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত যাত্রার এক অনুপম দলিল উপস্থিত ছিল।
প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল পঞ্চানন কর্মকারের হাতে তৈরি প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বছর পুরনো কাঠের হরফ, যেগুলি এক সময় ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত বই ও সংবাদপত্রে। বাংলা ভাষার বাইরেও আরবি, ফার্সি, মারাঠি, তেলেগু, বর্মি ও চীনা সহ প্রায় ৪০টি ভাষার জন্য তাঁর হাতে তৈরি টাইপফেসগুলি দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। এই বিরল নিদর্শনের মাধ্যমে অনেকেই প্রথমবারের মতো জানতে পেরেছিলেন কিভাবে তাঁর সহযোগিতায় উইলিয়াম কেরি ১৭৭৮ সালে বাংলায় ‘রামায়ণ’ এবং ১৮০১ সালে ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ মুদ্রণ করেছিলেন। তদ্ব্যতীত, ‘সমাচার দর্পণ’-এর ছাপাও তাঁর ছোঁয়াতেই সম্ভব হয়েছিল।
এই ঐতিহাসিক উপকরণসমূহ সংরক্ষিত ছিল পঞ্চানন কর্মকারের উত্তরসূরি প্রিয়াঙ্কা মল্লিকের পারিবারিক সংগ্রহে। তাঁর বাবা, বিমান মল্লিকের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল এই ঐতিহ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা — এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন আংশিকভাবে হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে। দর্শকদের ভিড়, উৎসাহ এবং আবেগ তাঁদের সেই প্রয়াসকে সার্থক করেছে।
প্রদর্শনীর আয়োজন ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিশিষ্ট কিউরেটর কৌন্তেয় সিনহা এবং ঐন্দ্রিলা রায় কাপুর। তাঁরা মনে করেন, এই প্রদর্শনী শুধু একটি ঐতিহাসিক প্রতিফলন নয়, বরং এটি বাংলা লিপির শিকড় ও সাংস্কৃতিক গৌরবের প্রতীক। প্রদর্শনীতে ছিল হরফ ছাড়াও হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, প্রাচীন ছাপার যন্ত্রাংশ এবং মুদ্রণপ্রযুক্তির বিবর্তনের সাক্ষ্য বহনকারী নানা উপাদান।
এই প্রদর্শনী যেন শুধুমাত্র অতীতচর্চার একটি আয়োজন ছিল না, বরং নতুন প্রজন্মের কাছে একটি উজ্জ্বল আলো যা দেখিয়েছে কোথা থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের মুদ্রিত ভাষার যাত্রা। বাংলা ভাষার অক্ষরের গায়ে যে স্পর্শ ছিল এক মনীষীর, সেই ইতিহাসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে এই উদ্যোগ।
খেলাত ভবনের দরজা আপাতত বন্ধ হলেও, ‘হরফ’ প্রদর্শনী রেখে গেছে এমন এক বার্তা — আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মূল শিকড় যতই পুরনো হোক না কেন, সেগুলি যত্নে তুলে ধরলে তা ভবিষ্যতের জন্য হয়ে ওঠে এক অমূল্য উপহার।