“সময় হল শেষ পর্যন্ত এখানে আসার?”
মিসেস রায়ের অফিসে ঢুকতে গিয়েই এই ওনার কথায় হচোট খেল উন্মেষ। একটু অপ্রস্তুত ভাবেই বলে উঠলো, “না মানে বাড়ির দিকটা দেখে শুনে, কর্পোরেশন এর থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যাঙ্কের কাজ কর্ম মেটাতে গিয়ে কোথা দিয়ে যে এই দেড় মাস কেটে গেল! আসলে উইকএন্ড ছাড়া তো এগুলো করা যায়না তার ওপর ব্যাঙ্কের সেকেন্ড ফোর্থ আর বারো মাসে তেরো পার্বণ এর ছুটি তো লেগেই আছে।”
মিসেস রায় আর বিশেষ কথা বাড়ালেন না। উন্মেষ কে তিনি স্নেহের চোখেই দেখেন। ওর সমস্যাগুলোও অজানা নয়।
উন্মেষ চেয়ার টেনে বসলেও কিন্তু ঠিক আরাম করে বসতে পারলো না। একটু ইতস্তত বোধ করতে করতেই কথাটা বলে ফেলল। “বলছি কি মিসেস রায়, মায়ের যা জিনিসপত্র এখানে আছে সেগুলো কি এখানেই রেখে দেওয়া যায় না? না মানে সবাই মিলেই ব্যবহার করতে পারে যদি আপনাদের অসুবিধে না হয়। মানে, আমার ফ্ল্যাটে আবার এই সব ফার্নিচার বই পত্র টিভি এসবের জায়গা বার করা মুশকিল। আজকালকার ফ্ল্যাটের সাইজ তো বোঝেন।”
মিসেস রায় উন্মেষের দিকে এক পলক তাকিয়ে তারপর টেবিলের ড্রয়ার টেনে একটা ফাইল বার করে উন্মেষের দিকে এগিয়ে দিলেন। ফাইলের প্রথম পাতাতেই একটা লম্বা লিস্ট করা আছে।
“উন্মেষ, দেখে নাও তোমার মায়ের কি কি জিনিষ আছে এখানে। তুমি চাইলে আমি সবটাই এখানে রেখে দিতে পারি। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার মায়ের যে দুটো ফটো অ্যালবাম আর গয়নার বাক্স আছে সে গুলোর আশা করি তোমার ফ্ল্যাটে জায়গা হয়ে যাবে। ওগুলো তো তোমার মায়ের আর তোমার ব্যক্তিগত স্মৃতির জায়গা, ওগুলো ভাগ করে লাভ নেই। কৃষ্ণাদি তো আমার দিদির মতোই ছিলেন তাই তার স্মৃতির অমর্যাদা হোক এটা আমি চাইব না।”
উন্মেষের মা কৃষ্ণা বসু এই কেয়ার হোম এ এসেছিলেন বছর দশেক আগে। একদম সেচ্ছায়। উনি চাননি ছেলে এগিয়ে এসে তাদের আলাদা থাকার বায়নাটা করে। ছোট বেলা থেকেই উন্মেষের সব দরকারের খেয়াল রেখেছেন হাতে। উন্মেষের বাবা অপনভোলা মানুষ ছিলেন। পূর্ব রেলওয়ের মেকানিকাল দপ্তরে ছিলেন। শেষ দিন পর্যন্ত অফিসের কাজই সামলে গেছেন। আর অফিসেই ওনার মৃত্যু। উন্মেষ তখন ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে ক্যাট এর জন্যে তৈরী হচ্ছিল। কৃষ্ণা দেবী চাইলে ওনার স্বামীর অফিসেই কাজ পেয়ে যেতেন। গ্রাজুয়েট মহিলা, ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ, দৈনন্দিন কাজকর্মে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখলেন ছেলের জন্যে আর নিজের জন্যে রাখলেন ফ্যামিলি পেনশন। উপস্থিত বুদ্ধিতে একুল ওকূল দু দিকেই সামলে নিলেন। পরিবারের মধ্যে এই জন্যই তিনিই সবার এতো প্রিয় ছিলেন। শশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ির সব কিছুতেই তিনিই থাকতেন সবার সঙ্গে, কিন্তু সতন্ত্র ভাবে।
উন্মেষের বিয়ে হয় তার কলেজের বান্ধবী ঋতুপর্ণার সঙ্গে। ঋতুপর্ণা সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়িক পরিবারের মেয়ে, কিন্তু উন্মেষের মধ্যবিত্ত পরিবারে সঙ্গে অনায়াসেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। বড়লোক বাপের বাড়ির কোনও দম্ভই তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেনি প্রথম কয়েক বছর। সে সামগ্রিক ভাবে শশুরবাড়ির সবার কাছের মানুষ হয়ে উঠতে চায়। একা হাথে সামলাতে চায় সব কিছু কিন্তু সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে সে কিছুতেই শাশুড়ি মায়ের ছায়ার বাইরে বেরোতে পারছে না। কৃষ্ণা দেবী নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও ঋতুপর্ণা একা প্রশংসার ভাগীদার হতে পারছে না। আত্মীয়স্বনদের মধ্যে থাকছে হয় শাশুড়ি বৌমার যৌথ কদর অথবা তুলনা।
দু’বছর ঘুরতে না ঘুরতে উন্মেষ ঋতুপর্ণার মধ্যে জায়গা করে নেয় তাদের সন্তান ঋষি। এর পর পরই উন্মেষের ট্রান্সফার হয়ে যায় মেট্রো রেলওয়েতে। যাতায়াতের সমস্যা দেখিয়ে ঋতুপর্ণা প্রস্তাব দেয় বেহালায় তার বাবার কেনা একটি ফ্ল্যাটে চলে যাওয়ার। কৃষ্ণা দেবী আর বাঁধা দেননি। সংসার ভাগ হয়। কৃষ্ণা দেবী স্বামীর তৈরী ব্যান্ডেল এর বাড়িতেই রয়ে গেলেন। ছেলে বৌমা সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাবও দেয়নি আর তিনিও যেতেন না।
প্রথম প্রথম উন্মেষ প্রতি সপ্তাহশেষে মায়ের কাছে আসত। অনেক সময় রাতেও থেকে যেত মায়ের কাছে। ঋতুপর্ণা আর ঋষিও এসে থাকত স্কুলের ছুটির সময়। তারপর যা হয়, আসা যাওয়া ক্রমেই কমতে থাকে। কৃষ্ণা দেবীও প্রথমে ব্যান্ডেল এর চেনা পরিচিত মহলে এটা সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, বেশ কিছু বছর কাটতে কাটতে একাকিত্ব ক্রমে গ্রাস করে ফেলে। বাড়িও পুরোনো হওয়াতে আজ এখানে ফাটল কাল ওখানে ড্যাম্প এর ঠ্যালা সামলাতে সামলাতে শেষে বাড়ী বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি। উন্মেষও রাজি হয়ে যায়। ওর তো সেই ছোটবেলার স্মৃতি আঁকড়ে প্রবণতা কোনদিনই ছিল না। কৃষ্ণা দেবী মিসেস রায় কে চিনতেন পারিবারিক সূত্রেই। মিসেস রায় তার স্বামী মারা যাওয়ার পরে তাদের আদিসপ্তগ্রামের ফার্ম হাউসটি একটি কেয়ার হোমে রূপান্তরিত করেন। মিস্টার রায়ের সেটাই ইচ্ছে ছিল। ওনার ওল্ড এজ হোম শব্দটিতে এ ভীষণ আপত্তি ছিল। কৃষ্ণা দেবীও সেখানে গিয়েই নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরলেন। কেয়ার হোমের একজন সাধারন পৌরজন থেকে সকলের পরিজন হয়ে উঠলেন। সকলকে নিয়ে বৈশাখী বৈঠক থেকে চৈত্রের অবসান অবধি বারো মাসের তেরো পার্বণ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে করতে, আজ মেডিক্যাল ক্যাম্প কাল এনজিও সেলফ হেল্প গ্রুপ এর মিটিং এই সব করে শেষের কটা বছর বেশ কেটেছিল।
বেহালায় যাওয়ার কয়েক বছর পরেই ঋতুপর্ণার বাবা মারা যান। ঋতু শেষের দিকটা বাবাকে ব্যবসাতে সাহায্য করলেও এর পর আর একা পেরে উঠল না । অগত্যা উন্মেশকে সরকারি চাকরি জলাঞ্জলী দিয়ে ঋতুদের পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরতে হল। সাবেকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে সাথে আইটি কনসালটেন্সিও শুরু করে দেয়। উপার্জনের দিক দিয়ে লাভই হলো তাতে। ফলে সত্তর কিলোমিটার দূরে কেয়ার হোমের থেকে সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে মিউনিখ যাওয়ার প্রয়োজন বেড়ে ওঠে। কৃষ্ণা দেবী যেদিন মারা যান উন্মেষ সেদিনও সিঙ্গাপুরে। ঋতুপর্ণা অবশ্য একাই পৌঁছে গিয়েছিল কেয়ার হোমে। আর উপস্থিত বুদ্ধিতে শেষ কৃত্যের ব্যবস্থা করে কলকাতায়, এবং সেখানকার সকলের অমতেই। মিসেস রায় একরকম মেনেই নেন, কৃষ্ণা দেবীর ইছাপত্রের অভাবে ব্লাড রিলেশন স্পিকস ইট অল। এতে অবশ্য উন্মেষের পক্ষেও তাড়াতাড়ি পৌঁছনো সম্ভব হয় আর কলকাতা করপোরেশন অঞ্চলে সব কাজ হওয়াতে ডেথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি পাওয়াও সহজ হয়ে ওঠে।
“এই বৃদ্ধাশ্রমের জন্য আমি যতটা খেটেছি, কৃষ্ণাদি এখানে আসার পর কিছু কম পরিশ্রম করেননি। শেষের এই ক’টা বছর এই আশ্রমই হয়ে উঠেছিল ওনার ধ্যান জ্ঞান। তুমি তো আর হয়তো আসার সময় পাবে না। যাওয়ার আগে একবার ভালো করে দেখে যাও জায়গাটা, তোমার মায়ের কর্মকাণ্ড।”, মিসেস রায়ের কথায় সম্বিৎ ফেরে উন্মেষের। মনে মনে বলে ওঠে মায়ের এই সর্বব্যাপীতাই তো সব সমস্যার কারণ।
“আমি শুধু আমিনিষ্ট্রেশন সামলেছি, এখাকার প্রত্যেকটি আশ্রমিকদের প্রাণের মানুষ হয়ে আছেন কিন্তু তোমার মা। তোমার মা কিন্তু আমায় বলে গেছেন তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাতে।”
উন্মেষ আর কালবিলম্ব না করে উঠে পরে। পুরো কেয়ার হোম ঘুরে সকলের সঙ্গে দেখা করে বেরোতে আরও এক ঘন্টা লেগে গেল।
ফেরার পথে গাড়িতে কেয়ার হোম থেকে দেয়া জুটের ব্যাগ থেকে কালো কাঠের গয়নার বাক্সটা টেনে নিল। মায়ের বিশেষ কিছুই সঙ্গে নেয়নি উন্মেষ। তাদের পুরোনো দুটি অ্যালবাম, মায়ের হাতে এমব্রয়ডারি করা একটা চাদর, চশমা আর ওই গয়নার বাক্স। উন্মেষ জানে যে ঋতু সস্নেহে তাদের ফ্ল্যাটে তার মা আর বাবার কোনও স্মৃতি চিহ্ন রাখতে দেয়নি। তবে এই কটা জিনিস নিয়ে হয়তো কিছু বলবেনা।
মিসেস রায় হ্যান্ডওভার করার সময় দেখিয়ে দিয়েছিলেন, গয়নার বক্সে রাখা মায়ের দু জোড়া সোনার চুড়ি আর একটা বালা আছে সঙ্গে একটা খামে চিঠি। উন্মেষ খাম থেকে চিঠিটা বার করে বাক্সটা সরিয়ে রাখল। মায়ের মারা যাওয়ার ৬মাস আগের লেখা চিঠি।
—————————————
“বাবু,
তোমার সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা বলা হলেও বেশ কিছু কথা কোনদিন বলা হয়ে ওঠেনি। তোমার তো সেভাবে আমাদের এই কেযার হোম ঘুরে দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। যে ক’বার দেখা হয়েছে ওই অফিস ঘরেই হয়েছে। আজ যদি সময় করে ঘুরে থাকো তাহলে বুঝবে শেষ বয়সটা আমি আনন্দ করেই কাটিয়েছি। এত ভালোর মধ্যেও কিছু খামতি তো ছিল। তবে আমার অসুবিধে হত না। তোমাদের আরেকটু সঙ্গে পেলে হয়তো আরও ভাল হতো।
ব্যান্ডেলের বাড়ি বিক্রির টাকা তো তুমি নাওনি। সেটার একটা অংশই আমায় এই কেয়ার হোমে এ জমা রাখতে হয়েছিল। নিজের জন্যে অল্প কিছু রেখে বাকিটা অংশটা কয়েক বছর পর আমি ওদের ট্রাস্টকেই দান করে দিয়েছি। আমার অবর্তমানে তুমি কিন্তু আমার প্রথমে জমা রাখা টাকার সত্তর শতাংশ, আর এই এতগুলো বছরের ইন্টারেস্ট সমেত ফেরত পেয়ে যাবে। নমিনেশনে তোমার নামই দেওয়া আছে। টাকাটা মূল্য কিন্তু নেহাৎ অল্প নয় । ওদের কাছে সব হিসেব আছে। তোমার এই সময় হয়তো টাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বয়সকালে হয়তো প্রয়োজন পড়তে পারে আর মনে রাখবে এটা কিন্তু তোমার জয়েন্ট আকাউন্ট নয়, এটা তোমার নিজের টাকা। তুমি এটা তোমার মতন করে ব্যবহার করো। বৌমাকে আশীর্বাদ জানিও, তুমি ভাগ্যবান যে ওর মত বউ পেয়েছ। দাদুভাই কে বোলো আমার স্নেহাশীষ থাকবে ওর সঙ্গে সবসময়। এই বছর কয়েক পর তো তোমার মতনই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠবে। এর পর শেষ বয়েসে যদি তোমার নীড়ের প্রয়োজন পরে তখন কেয়ার হোমের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আমি এখন ওখানকার ট্রাস্টি মেম্বার। তোমাকে আমার মত টাকা জমা করে আসতে হবে না। সে ব্যবস্থা আমি করে গেছি। ডিপোজিট এর থেকে যে টাকা ফেরত পাবে তার থেকে এখানে থাকতে – এসি, ফ্রিজ আর যা যা প্রয়োজন পড়বে কিনে নিও…”
এরপরটা উন্মেষ আর পড়তে পারলো না। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।